বুধবার ৩০ এপ্রিল ২০২৫
সম্পূর্ণ খবর
UB | ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ২০ : ৫৯Uddalak Bhattacharya
গৌতম রায়
‘খোঁয়ারি’ গল্পের শুরুতেই আগন্তুকের অনেকটা সময় ধরে দরজায় কড়া নাড়া, তারপর, ওপরতলা থেকে সাড়া দেওয়ার যে অসামান্য জাদু বাস্তবতার ছবি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এঁকেছেন, মানবসমাজে যে কোনও স্তরের সংখ্যালঘু মানুষ, তা তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু হোন বা ভাষা, জাতি, লিঙ্গ, বর্ণ-যার ভিত্তিতেই নিজের পরিমন্ডলীতে সংখ্যালঘু হোন-সেই প্রান্তিকতার চিত্রকল্প, এই স্বপ্ন বাস্তবতার থেকে বোধহয় আর ভাল কিছু হতে পারে না। একজন আগন্তুক এসে বহু সময় ধরে দরজায় কড়া নাড়ছেন। তারপর অনেকক্ষণ কেটে গিয়েছে, বাড়ির মানুষদের নিজের উপস্থিতি জানান দিতে। এই ‘অনেক্ষণে’-এর ভিতরে আগন্তুকের অনেককিছুই ঘটে যেতে পারত। হয়ত আগন্তুক বাইরের কোনও হিংসাশ্রয়ী আক্রমণকারীদের তাড়া খেয়ে কোনও মতে নিজের বাড়িতে এসে প্রাণ বাঁচাতে পড়িমরি করে একান্ত আপনজনেদের ডাকছেন, তবুও সাড়া পাচ্ছেন না। এই ডেকে সাড়া না পাওয়ার ভিতর দিয়ে প্রথমেই যে প্রশ্নটা উঠে আসে, হানাদারদের দ্বারা আক্রান্ত বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া একজন মানুষ, তিনি যেটাকে তাঁর নিরাপদ আশ্রয় বলে মনে করেছিলেন, যেখানকার মানুষদের তিনি মনের গোচরেই হোক আর অগোচরেই হোক ‘পরমাত্মীয় প্রতিম’ মনে করেছিলেন, তাঁর এই বিপদে কেন সেই কাঙ্খিত মানুষদের এই বিলম্ব? এই দেরি কি ইচ্ছাকৃত? আগন্তুকের প্রতি কি বাড়ির মানুষজনগুলোর একটা অহেতুক অবহেলার মানসিকতা আছে? তাচ্ছিল্যের মনোভাব আছে? তাই কি আগন্তুককে অনেকটা সময় ধরে দরজার কড়া নাড়তে হচ্ছে? নাকি স্থানকালের ঘটনাক্রমে বাড়িতে থাকা মানুষজন ও আগন্তুকটির দরজা খোলানোর তাড়ার মতোই, দেখেশুনে, বুঝেশুনে দরজা খোলবার একটা বিশেষ দায় আছে? আগন্তুক যেমন তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢুকতে চান, তাই সে বিরামহীন ভাবে দরজাতে কড়া নেড়েই চলেছে, নেড়েই চলেছেন- তেমনটাই কোনও তাগিদ থেকে কি বাড়িটার বাসিন্দাও দেরি করেই চলেছেন, করেই চলেছেন?
গল্পের শুরুতেই এই যে দু’টি পর্বের দু’টি মানুষের দেরির একটা প্রেক্ষাপট ইলিয়াস রচনা করেছেন-মানবসমাজের যে কোনও প্রেক্ষাপটের সংখ্যালঘুর ক্ষেত্রেই এই ‘দেরি’, ‘বিলম্ব’ বিষয়টা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। এই ‘দেরি’, সেটা আক্রান্তেরই হোক, সমাজেরই হোক, প্রশাসনেরই হোক- যে কোনও সংখ্যালঘুর জীবন এবং যাপনচিত্রের কাছে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই গুরুত্বটাকেই যেন আমরা ইলিয়াসের এক অনবদ্য ভঙ্গিমায় আখ্যানচিত্র নির্মানের একদম প্রথমপর্বেই দেখতে পাই। ইলিয়াস কিন্তু গল্পটির সূচনাপর্বে একটি বারের জন্যেও বলছেন না, গল্পের অন্যতম মুখ্য চরিত্র ‘অমৃতলাল’-এর বিপন্নতাটা কোন পর্যায়ের। ধর্মীয় বিপন্নতায় ভুগছেন অমৃতলাল? নাকি আর্থিক বিপন্নতা তাঁকে একধরণের সামাজিক বিপন্নতায় ঠেলে দিয়েছে, যে বিপন্নতাকে সাধারণভাবে আমরা ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর সমাজে একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বিপন্নতা বলে মনে করে থাকি, তেমন কোনও বিপন্নতার শিকার নাকি অমৃতলাল?
এপার বাংলার প্রেক্ষিতে এমন গল্পে লেখক কি ‘অমৃতলাল’ নামটির পরিবর্তে চরিত্রটির নাম, ‘ইসমাইল’ বা ‘সালেক’ রাখতেন? এই প্রশ্নগুলি উঠবে কি উঠবে না-এমন একটা দোলাচালের ভিতরেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আগন্তুকের দীর্ঘসময় ধরে দরজার কড়া নাড়বার পরে বাড়িটি ‘ওপরতলা’ থেকে ‘যাই’ এর ব্যঞ্জনা। ‘ওপরতলা’ শব্দটি এখানে নিছকই একটা বাড়ির কোনও ফ্লোরকে বোঝানো হচ্ছে? তা মনে হয় না। ইলিয়াস এখানে নিসঃঙ্গতার সামাজিকীকরণে, একজন, যে, কোনও অর্থে সংখ্যালঘু, মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক বিপন্নতার সুলুক সন্ধানে ব্রতী হয়েই সমাজের ওপরতলার একটা দ্যোতনা হিসেবেই, ‘খোঁয়ারি’ গল্পের শুরুতে এই ‘ওপরতলা’ শব্দটিকে তুলে এনেছেন?
অমৃতলাল যে বাড়িতে ঢোকেন, সেই বাড়িতে মাধবীতলার ঝোপে যেসব পোকামাকড় রয়েছে, তাদের চলাফেরার শব্দ ছাড়া আর কোনও প্রাণের স্পন্দন নেই। প্রান্তিকতার চরম বিন্যাসের কী অসাধারণ চিত্রকল্প। একজনের নিঃসঙ্গতা, সেটা যে কোনও কারণে হতে পারে। সেই নিঃসঙ্গতার পিছনে মানুষটির ব্যক্তিগত যাপনজনিত সমস্যা থাকতে পারে। থাকতে পারে যেকোনও পর্যায়ে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বার যন্ত্রণা। এমন একটা মানুষ বহু ডাকাডাকি করিয়ে, একটা কেবলমাত্র, ‘আসি’ ডাক শোনবার পরে বাড়িতে ঢোকা এবং ঢোকবার পর মাধবীলতার ঝোপে কেবলমাত্র পোকামাকড়ের উপস্থিতিই টের পাওয়া, অন্য সবদিক থেকে ‘স্পন্দনহীন’ বাড়ি-এই যে ছবি, এই ছবির ভিতর দিয়েই উঠে আসে কলরব থেকে একজন মানুষের একটা নির্দিষ্ট প্রান্তিকতায় নিমজ্জিত হওয়ার প্রাথমিক হাহাকার। গল্পটির একদম প্রথম অনুচ্ছেদের একটি দু’টি লাইনের ভিতর দিয়েই ইলিয়াস বুঝিয়ে দেন, প্রান্তিক মানুষ, তা তিনি যে আঙ্গিকের জেরেই প্রান্তিক হোন না কেন, সেই মানুষটি মানবসমাজে এক অতি অভাগা সংখ্যালঘু।
সংখ্যালঘু শব্দটাকে আমরা বাঙালিরা কেবলমাত্র ধর্মীয় পরিমন্ডলে দেখতেই ক্রমশঃ অভ্যস্থ হয়ে উঠছি। মানবিক পরিমন্ডলের একটা বৃহত্তম পরিসীমাতে এই ‘সংখ্যালঘু’ বিষয়টিকে আমরা আজ পর্যন্ত দেখতে অভ্যস্থ না হলেও , ইলিয়াস কিন্তু কখনওই কোনওরকম ছোট আবর্তের ভিতরে সংখ্যালঘুর মন বা মননের বিশ্বকে নিজের চিন্তাতেই আনেননি। আর আনেননি বলেই যে কোনও সংখ্যাগুরু সমাজে ব্যতিক্রমী ভাবনার মানুষও যে তার নিজের সমাজে সংখ্যালঘু-এই বোধকেও ইলিয়াস কখনওই অস্বীকার করেননি। যদি তাঁর ব্যক্তিজীবনের রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিকেও আমরা তাকাই, সেখানেও কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক স্রোতে তিনি সংখ্যালঘুই ছিলেন। তাঁর ব্যতিক্রমী বামপন্থী রাজনীতির পথে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ হয়েও তিনি নিঃসঙ্গ ছিলেন।
এই চিন্তার ভাবুক যিনি, তিনি ও কিন্তু তাঁর স্বদেশের ভাবুককুলে যথেষ্ট ব্যতিক্রমী চিন্তার মানুষ ছিলেন। আর তাঁর সেই ব্যতিক্রমী চিন্তার জন্যেই তাঁকেও যদি আমি একজন ‘সংখ্যালঘু’ বলি , মনে হয় না ভুল হবে। আর নিজে ‘সংখ্যালঘু’ ছিলেন বলেই ইলিয়াস প্রান্তিক অবস্থানে থাকা মানুষজনের মনের গহীনে এই ভাবে ডুব দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সংখ্যালঘুর মনস্তত্ত্ব অনুভব করে তাঁদের স্বাধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার হওয়া আর সংখ্যালঘু হিসেবে নিজেকে প্রিভিলেজ ক্লাস মনে করা- এ দু’টোর ভিতরে যে ফারাক- ইলিয়াস অন্তর থেকে সেটা অনুভব করতেন। সেটা করতেন বলেই একজন যাথার্থ মানুষের মতো ধর্ম থেকে শুরু করে রাজনীতি, কোনও কিছু ঘিরেই নিজের জীবনে যেমন ‘প্রিভিলেজ’ শব্দটার সঙ্গে কখনও মিতালি পাতাননি, তেমন ভাবেই সংখ্যালঘুর সুযোগ যাঁরা উপভোগ করতে চান, সেটা কী ভারত, কী বাংলাদেশ, সেই অংশের মানুষদের সঙ্গেও কখনও বন্ধুত্ব তৈরি করেননি।
সেই বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর ইলিয়াসের স্বল্পায়ু জীবনের প্রতিটি পরতে জড়িয়ে আছে। খোঁয়ারি গল্পে ইলিয়াস লিখছেন, ‘ভেতরে ৪\৫ গজ জায়গা পাকা পাকার ফাটলে রক্তহীন ঘাসের কদমছাঁট চাপড়া’। (এখানে মনে হচ্ছে ইলিয়াসের লেখায় এই ৪,৫ এমনতর সংখ্যার ব্যবহারে তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎতের দিন, সরাসরি তাঁকে আপত্তি জানিয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর। ইলিয়াসের সৃষ্টির রসোত্তীর্ণ ধারায় এই সংখ্যার ব্যবহারটা রসের হানি ঘটিয়েছে বলে মনে করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর। ইলিয়াস তাঁকে গোটা ব্যাপারটা ভেবে দেখবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই ঘটনাপ্রবাহের আর একজনমাত্র সাক্ষীই আজ আছেন। তিনি ইলিয়াসপত্নী পরমশ্রদ্ধেয়া সুরাইয়া ইলিয়াস) এই যে শব্দচয়ণ, ‘রক্তহীন ঘাসের কদমছাঁট চাপড়া’- এই শব্দবন্ধ যেন চিনিয়ে দিচ্ছে ঘাসের মতো বস্তু, যে বস্তুকে আমরা তুচ্ছাতিতুচ্ছ যে ভাবি, এমন কি জেনেও থাকি- সেই তুচ্ছতার ক্লিন্নতায় রক্তহীনতার হাহাকার কি প্রত্যয় রচনা করে।ঘাসের শুকিয়ে যাওয়া আমরা দেখি।দেখেও হয়তো কোনও প্রতিক্রিয়াই আমাদের হয় না। জীবনানন্দের মতো প্রকৃতি ঘিরে প্রতিক্রিয়া জানাবার চোখ, মন, সর্বপরি সময় আমাদের কোথায়? ঋত্ত্বিকের ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যবহারে ঘাসে ঘাসে পা ফেলবার মোটা দাগের পিকচারাইজেশন, তা নিয়েই আমরা বন্ধুরা মেতে উঠি তরজায়। কিন্তু ঘাসের শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে রক্তহীনতার এই তুলনা- এমন শৈল্পিক ভাবনার সঙ্গে নিজেদের মন আর মননকে সম্পৃক্ত করবার মতো মানসিকতা এবং সময় কোথায় আমাদের? আমরা তো এখন প্রচন্ড ব্যস্ত!